রবিবার, ৭ এপ্রিল, ২০১৯

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা সমীর রায়চৌধুরীর চিঠি

কোচিন
৮.১.১৯৬৩
সুনীল,
তোর ২৭/১২ তারখের চিঠি পরে পেলাম । আমার এই ট্রেনিঙ মোটেই ভালো লাগছে না । ফলে মনমেজাজ কৃষকের মতো হয়ে গেছে । ট্রেনিঙটা ছেড়ে যাবারও সাহস নেই, তাহলে চাকরী যাবে । চাকরী গেলে বউ, আবার এই ফেব্রুয়ারিতেই ছেলে বা মেয়ের সিকিউরিটির ভার পড়বে । ফলে কোনো মতে জুন অব্দি এই কষ্ট সহ্য করতে হবে । জুনের পর এক বছে টুর । টুর মন্দ লাগে না ঘুরতে ঘুরতে । সমুদ্র সম্পর্কে প্রচণ্ড বিরক্তি ধরে গেছে । সমুদ্র দেখলেই ভীষণ ক্রোধ হয়, যেন প্রতিদ্বন্দ্বী আমার ।

বেলাকে নিয়ে ঘর করা খুব সুখকর । ভারী সরল ও নিপুণ মেয়ে । মনের মতন বউকে মেয়েমানুষ মনে হয় না, বরং বন্ধু ঘনিষ্ঠ অতি । নিজেকে খুব সিকিওর্ড মনে হয় । আমার মনে হব পৃথিবীর যেকোনো নারীর সঙ্গে একটা অন্তঃশীল মাতৃত্বের সম্পর্কই সব চেয়ে সুখময় । অনেক বঢ় হয়ে গেলেও আমাদের শিশু মরে যায় না, ঝরে যায় না । তোর মা এবং ভাইবোনেদের সঙ্গে কলকাতায় থাকা ছাড়া আর কোনো কিছুকেই আমার ঈর্ষা হয় না । মেয়েমানুষ সম্পর্কে তোর মতামত আমি মানি না । এটা ঠিক যে মেয়েমানুষের কাছে কেবল লিঙ্গ উপস্হাপনার কোনো অস্তিত্ব নেই । সব মেয়েমানুষ সমান নয় । ফলে মেয়েমানুষ খুঁজে বের করাই কঠিন ।

কৃত্তিবাসের জন্য আমি ৬০ টাকা দেবো । যখনই দরকার তৎক্ষণাৎ পাঠাব । এখনই কি পাঠাবো ? পাঠাচ্ছি না এই জন্য যাতে কৃত্তিবাসের ঠিক প্রয়োজনের সময় পাস । নয়তো খরচা হয়ে যাবার বিড়ম্বনা তোর হয়তো হতে পারে । যাই হোক, আমাকে যখনই বলবি, পাঠাবো । ঐ কাগজগুলো সম্পর্কে ভাবিস না, শক্তির বন্ধুত্বে ও আমার নষ্ট সম্পত্তির মধ্যে আমি ধরে নিয়েছি ।

হাংরি জেনারেশনের প্যামফ্লেট-এ যা লিখেচি সে হয়তো তোরই বক্তব্য । তোর কি ভালো লাগেনি ?

কৃত্তিবাসের জন্য একটা ভালো গদ্য লিখেছি । শীগগিরই পাঠাবো । প্রেমিক-প্রেমিকারা পরস্পরকে যাকিছু দেয় তারই পরিণতি সম্পর্কে বক্তব্য । জানি, মেঘ, গান, মূর্তি প্রত্যেকটির গমনাগমন তুলে ধরার চেষ্টা করেছি । অর্থাৎ এই পাখি আকাশ না খুঁজে খাঁচা চায়, মেঘ শষ্যের দিকে ডোবে । গান প্রতিধ্বনি আনে না । পাঠালে হয়তো বুঝতে পারবি ।

অলোকরঞ্জনের হয়তো অকারণে কিছু ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স আছে, ওর নিজের ঈশ্বর সম্পর্কে । আমি অলোকরঞ্জনকে একবারই দেখেছিলাম বালিগঞ্জে । কথাবার্তায় একথাটা আমার মনে হয়েছিল । কেন ঠিক মনে নেই । তখন শক্তিকে বলেছিলাম ।

চিঠি দিস । প্রীতি রইলো ।
সমীর

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা সমীর রায়চৌধুরীর চিঠি

কোচিন
৩১.১২.১৯৬২
সুনীল,
এইমাত্র তোর ২৮/১২ তারিখের চিঠি পেলাম । ২৭/১২ তারিখেও ওই একটা চিঠি পোস্ট করেছিস লিখেছিস, সেটা তো কই পাইনি । কাগজ সম্পর্কে লিখেছিস । শক্তি এসব ব্যাপারে আমাকে যথেষ্ট মানসিক কষ্ট দিয়েছে । কাগজ শক্তির উপস্হিতিতে শক্তির ইচ্ছানুযায়ী কেনা হয়েছিল । শক্তির সাজেশানেই প্রেসে পাঠানো হয়েছে । শক্তিকে বহুবার অনুরোধ করেছিলাম কাগজটা ওর ওখানে বা তোর ওখানে রাখতে অথবা মলয়ের বইয়ের ব্যাপারটা তাড়াতাড়ি শুরু করতে । শক্তি কোনোদিন কান দেয়নি । শক্তি কি করছে শক্তিই জানে । যদি শক্তি নিজের ব্যাপারে ব্যবহার করে থাকে তো ভালোই । তা না হলে স্বস্তিককেই মেরে দিতে দে । আমার পক্ষে এ ব্যাপারে জড়িত হওয়া আর সম্ভব নয় । শক্তির সঙ্গে অর্থ বা material জনিত কোনো যোগাযোগ আমি রাখতে চাই না । কেননা এতে বারবার আমাকেই কষ্ট পেতে হয় । এই কাগজের সম্পর্কে শক্তির মাধ্যমে কোনোরূপ উদ্ধারের চেষ্টা করিস না।

কৃত্তিবাসের কাগজের জন্য তুই ভাবিস না । কৃত্তিবাসের কাগজ সবাই মিলে কিনে নেওয়া যাবে । এ ব্যাপারে আমাকে জানালেই আমি টাকা পাঠাবো । আজ হঠাৎ এই কাগজের জন্য শক্তির দরদের কোনো প্রয়োজন নেই ।
প্রীতি রইলো
সমীর রায়চৌধুরী

( শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে পাঠানো টাকার কোনো হদিশ পাননি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় । কৃত্তিবাস প্রকাশ সেকারণে আটকে গিয়েছিল । )

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা মলয় রায়চৌধুরীর চিঠি

১৬.৬.১৯৬৩
পাটনা
কি ঠিক করলেন সুনীলদা ? হাংরি জেনারেশনের dejure নেতৃত্বটা গ্রহণ করবেন, নাকি defacto নেতাকেই নেতা ভেবে রাগ করে থাকবেন ?
মলয়

( defacto নেতা ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় । মলয় রায়চৌধুরী নিজেই ছিলেন dejure নেতা । শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে defacto নেতৃত্ব দেবার জন্য সেই সময়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন । )

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা মলয় রায়চৌধুরীর চিঠি

১.৭.১৯৬২
সুনীলদা
আমার বইটা পেলাম । শক্তিদাকে বলবেন বাজার থেকে প্রতিটি কপি ফিরিয়ে নিতে এবং যতো কপি আছে তাদের সকলকে একত্রিত করে কেরাসিন তেল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিতে ।
প্রণামান্তে 
মলয় রায়চৌধুরী

( উল্লিখিত বইটির নাম 'মার্কসবাদের উত্তরাধিকার' , যা বিক্রয়ের জন্য কোনো দোকানে দেননি শক্তি চট্টোপাধ্যায় । বইটি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের উল্টোডাঙা বাড়ির সামনে জড়ো করে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন মলয় রায়চৌধুরী । মলয় এই ঘটনার জন্য সুনীলের ওপরও ক্রুদ্ধ ছিলেন, তার কারণ বইটি প্রথমে সুনীল নিজে প্রকাশের দায়িত্ব নিয়েছিলেন ।)