রবিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১১

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-এর চিঠি ( সমীর রায়চৌধুরীকে লেখা )

৩২/২ যোগীপাড়া রোড
কলকাতা ২৮
৯/১১/১৯৬৫

সমীর
মলয়ের ৫ তারিখের মামলার বিস্তৃত বিবরণ নিশ্চয়ই ওদের চিঠিতে জানতে পারবি, বা জেনে গেছিস। সে সম্পর্কে আর লিখলাম না।
দুটি ব্যাপার দেখে কিছুটা অবাক ও আহত হয়েছি। তুই এবং মলয় ইত্যাদি ধরেই নিয়েছিলি আমি মলয়ের স্বপক্ষে সাক্ষী দেবো না --- বরং অন্যান্যদের বারণ করবো, কোনোরকম সাহায্য করবো না। তোর অনুরোধ ছিল -- 'শেষ অনুরোধ' --- যেন আমি প্রথম দ্বিতীয় বা চতুর্থ অনুরোধ আগে প্রত্যাখ্যান করেছি। মলয়ও কয়েকদিন আগে সকালে আমার বাড়িতে এসে বললো, ওর ধারণা আমি চারিদিক থেকে ওর সঙ্গে শত্রুতা করছি এবং অপরকে ওর সঙ্গে সহযোগীতা করতে বারণ করছি।
অপরপক্ষে, মামলার রিপোর্ট কাগজে বেরুবার পর --- কফি হাউসের কিছু অচেনা যুবা, স্বতঃপ্রবৃত্ট হয়ে আমাকে অভিনন্দন জানাতে আসে। আমি নাকি খুবই মহৎ ব্যক্তি--- হাংরি জেনারেশনের সঙ্গে কখনো যুক্ত না থেকেও এবং কখনো পছন্দ না করেও যে ওদের স্বপক্ষে সাক্ষী দিয়েছি--- সেটা নাকি আমার পক্ষে পরম উদারতার পরিচয়।
ওদের ওই নকল উদারতার বোঝা, এবং তোদের অন্যায্য অবিশ্বাস --- দুটোই আমার কাছে হাস্যকর মনে হল। মানুষ কি স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে ভুলে গেছে ? আমার ব্যবহার এ-প্রসঙ্গে আগাগোড়া যা স্বাভাবিক তা-ই। আমার স্ট্যান্ড আমি অনেক আগেই পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছি। আমি হাংরি জেনারেশন পছন্দ করি না ( সাহিত্য আন্দোলন হিসেবে ), আমি ওদের কিছু-কিছু পাজী ব্যবহারে বিরক্ত হয়েছি। মলয়ের দ্বারা কোনোদিন কবিতা লেখা হবে না --- আমার রুচি অনুযায়ী এই ধারণা । অপরপক্ষে, লেখার জন্য কোনো লেখককেই পিলিশের ধরার এক্তিয়ার নেই --- একথা আমি বহুবার মুখে এবং কৃত্তিবাসে লিখে জানিয়েছি। পুলিশের বিরুদ্ধে এবং যেকোনো লেখকের স্বপক্ষে ( সে লেখকের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক যাই হোক না ) দাঁড়ানো আমি অত্যন্ত স্বাভাবিক কাজ বলেই মনে করি। কারুর লেখা আমি অপছন্দ করি বলেই তার শত্রুতা করবো, কিংবা অন্য কারুকে নিবৃত্ত করবো তাকে সাহায্য করতে --- এরকম নীচতা কী আমার ব্যবহারে বা লেখায় কখনো প্রকাশ পেয়েছে? এসব ছেলেমানুষী চিন্তা দেখলে -- মাঝে মাঝে রাগের বদলে হাসিও পায়।
যাই হোক, আদালতের সাক্ষ্যতে আমি দুটি কথা বলেছি। মলয়ের লেখার মধ্যে অশ্লীলতা কিছুই নেই--- এবং ও লেখাটা ( প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার ) আমার ভালোই লেগেছে। ধর্মসাক্ষী করে আমি দ্বিতীয় কথাটা মিথ্যে বলেছি। কারণ কয়েকদিন আগে মলয় যখন আসে --- তখন আমি বলেছিলুম যে ওর লেখা আমি পছন্দ করি না। কিন্তু শ্লীল-অশ্লীলের প্রশ্নটি জেনারাল, এবং সেই জেনারাল প্রশ্নে আমি অশ্লীলতা বলে কিছুই মানি না। সুতরাং সেই হিসেবে মলয়ের লেখাও যে কিছুমাত্র অশ্লীল নয় তা আমি সাক্ষীর মঞ্চে উঠে স্পষ্টভাবে বলতে রাজী আছি। তখন মলয় আমাকে অনুরোধ করে, আমি যদি ওকে সাহায্য করতে চাই, তবে জজসাহেবের সামনে ওর কবিতা আমার খারাপ লাগে এটাও যেন না বলি। আদালত তো আর সমালোচনার জায়গা নয়। বরং ওর কবিতা আমার ভালো লাগে বললেই নাকি কেসের পক্ষে সুবিধে হবে।
সাক্ষীর কাঠগড়ায় মলয়ের কবিতা আমাকে পুরো পড়তে দেওয়া হয়। পড়ে আমার গা রি-রি করে। এমন বাজে কবিতা যে আমাকে পড়তে বাধ্য করা হল, সে জন্য আমি ক্ষুব্ধ বোধ করি--- আমার সময় কম, কবিতা কম পড়ি, আমার রুচির সঙ্জগে মেলে না --- এমন কবিতা পড়ে আমি মাথাকে বিরক্ত করতে চাই না। মলয়ের তিনপাতা রচনায় একটা লাইনেও কবিতার চিহ্ণ নেই। মলয় যদি আমার ছোট ভাই হতো, আমি ওকে কবিতা লিখতে বারণ করতাম অথবা গোড়ার অ-আ-ক-খ থেকে শুরু করতে বলতাম। যাই হোক, তবু আমি বেশ স্পষ্ট গলাতেই দুবার বলেছি ওর ঐ কবিতা আমার ভালো লেগেছে। এর কারণ, আমার কোনো মহত্ব নয়--- আমার সাধারণ, স্বাভাবিক, সীমাবদ্ধ জীবন। যে-কারণে আমি আনন্দবাজারে সমালোচনায় কোনো বাজে বইকে ভালো লিখি --- সেই কারণেই মলয়ের লেখাকে ভালো বলেছি। যাই হোক, সেদিন আদালতে গিয়ে মনে হল, হাকিম এবং পুলিশপক্ষ এ-মামলা ডিসমিস করে দিতে পারলে বাঁচে--- কিন্তু মলয়ের প্রগলভ উকিল ও-মামলা বহুদিন ধরে টেনে নাম কিনতে চায়।
ডিসেম্বরের ৮-৯ তারিখে পাটনায় আমেরিকান সাহিত্যের ওপর একটা সিম্পোসিয়াম হবে। আমি তাতে যোগদান করার জন্য নিমন্ত্রিত হয়েছি। ঐ-সময়ে আমি পাটনা যাবো। আশা করি ভালো আছিস।
                                                                                                                          সুনীল

( মুর্শিদ এ এম সম্পাদিত 'হাওয়া ৪৯' পত্রিকার এপ্রিল ২০০১ সংখ্যা থেকে নিয়েছি )
                               

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন